Header Image

ত্রিশালে ৪০ দিনের কর্মসূচির টাকা পড়ে আছে ব্যাংকে!

রাকিবুল হাসান ফরহাদঃ 
ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল  উপজেলায় অতি দরিদ্রদের জন্য গৃহীত ৪০ দিনের কর্মসৃজন প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও নানা অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে শ্রমিক দের মুজুরীর ৩ ইউনিয়নের প্রায় ৭৫ লক্ষ টাকা ব্যাংকে আটকা পড়ে আছে। চলমান মহামারী করোনা পরিস্থিতিতে মানুষ করোনা আতঙ্কে ঘরে অবস্থান করায় চরম খাদ্য সংকটে পড়ায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মানবিক প্রধানমন্ত্রী ঘরে ঘরে  খাদ্য সামগ্রী  পাঠিয়ে মানুষের প্রতি মানবতার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেও করোনার পুর্বে অতি দরিদ্র এসব গরীব মানুষের কর্মসৃজন প্রকল্পে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাজ করেও মুজুরীর টাকা দুঃসময়ে ও সংকট মুহূর্তে  না পাওয়ায় বিভিন্ন মহলে দেখা দিয়েছে তীব্র সমালোচনা। উপজেলার হরিরামপুর,আমিরাবাড়ী ও মোক্ষপুর ইউনিয়নে কর্মসৃজন কর্মসুচীর শ্রমিক নিয়োগে প্রকল্প চেয়ারম্যান ও ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের বিরুদ্ধে অনিয়ম সহ ব্যাপক দুর্ণীতি হয়েছে বলেও জানান স্থানীয়রা। পরে অবশ্য চেয়ারম্যানগন এসব দুর্ণীতির দায়ভার চাপিয়ে দিয়েছেন উপজেলা প্রশাসনের উপর।
খোজ নিয়ে জানা গেছে- ত্রিশাল উপজেলায় কর্মসৃজন প্রকল্পের আওতায় হরিরামপুর ইউনিয়নে ৩৪২ জন, আমিরাবাড়ীতে ২৯০ জন,মোক্ষপুরে ৩৭৬জন শ্রমিক  ৪০দিনের কর্মসুচীর কাজ করে।  ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সমাপ্ত দেখানো হলে মার্চ২০২০মাসে ব্যাংক একাউন্টে কর্মসূচিতে কাজ করা এসব শ্রমিকের মুজুরীর টাকা জমা হলেও করোনায় অর্থাভাবে পরে গরীবের ঘরে খাবার সংকটে  ক্ষুধার জ্বালায় ছটফট করলেও রহস্যজনক কারণেই  শ্রমিকদেরকে কাজের মুজুরীর টাকা দেওয়া হয়নি। আর সম্পন্ন হওয়া এসব প্রকল্পে শ্রমিকের এমন কিছু নাম রয়েছে যারা জানেই না তাদেরকে শ্রমিক বানানো হয়েছে। সঠিক কাজ না হওয়ায় উপজেলায় গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষন, সংস্কার, নতুন রাস্তা নির্মাণ ও দরিদ্রদের কর্মসংস্থান ব্যাহত হয়। পাশাপাশি ব্যাপক ক্ষতি হয় সামাজিক উন্নয়নের। বৃত্তভান দের নাম দিয়ে শ্রমিক নিয়োগে অনিয়ম থাকায়  প্রকল্প থেকে সুবিধা বঞ্চিত হয়েছিল প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের অতিদরিদ্ররা। রাস্তা ঘাটের উন্নয়ন কাজ না হওয়ায় চরম অবনতি হয়েছে। কর্মসুচীর নাম করে ভূয়া শ্রমিকের তালিকা দিয়ে কন্ট্রাক্ট ভিত্তিতে সরকারের অর্থ হাতিয়ে নেওয়াই ছিলো তাদের মুল উদ্দেশ্য।
আমিরাবাড়ী ইউনিয়নের সমর পিয়নের বাড়ী হইতে পুর্ব আমিরাবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয় পর্যন্ত প্রকল্পের শ্রমিক কাশিগঞ্জ বাজার এলাকার মৃত টাক্কু চৌহানের স্ত্রী কমলী রাণী জানান-আমি সুপ্রিম বীজ কোম্পানিতে চাকরী করি।আমি কোন মাটির কাজ করিনা। কর্মসুচীর শ্রমিক হিসাবে নাম দেওয়ার বিষয়টি তিনি অবগত নন বলেও দাবী করেন। গোপালপুর এলাকার ইসব আলীর ছেলে আনিছুর রহমান জানায়- সে তার নিজস্ব ট্রাক্টর দিয়ে ফসলী জমি চাষাবাদ করে। শ্রমিকের নামের তালিকায় নাম আছে সেটা সে জানেনা। স্থানীয় দর্শক চরকীবাড়ী কাশেমের ছেলে আলী আকবর জানায় -এই প্রকল্পে ৪/৫দিন কাজ হয়েছে। তবে মাটি পরিস্কারের কাজ।
এ বিষয়ে ইউপি চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান ভূট্রো জানায়- কর্মসূচী শতভাগ কাজ বাস্তবায়নের জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। শ্রমিক নিয়োগে অনিয়মের কথা তিনি অস্বীকার করে বলেন এ ধরণের কোন অনিয়ম হলে সরকারের টাকা সরকারকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। শ্রমিকের মুজুরী পরিশোধ না করার বিষয়ে তিনি জানান উপজেলায় একটু সমস্যা থাকায় টাকা উত্তোলন হচ্ছেনা, তবে সমস্যা সমস্যা সমাধান হলে শ্রমিকের মুজুরী দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
উপজেলার হরিরামপুর ইউনিয়নের কর্মসৃজন প্রকল্পের শ্রমিকের আংশিক উত্তোলন করা হলেও শ্রমিকদেরকে দেওয়া হয়নি পুরো টাকা।এমন অভিযোগ করেছেন প্রকল্পের শ্রমিকরা। সরেজমিনে ইউনিয়নের নিগুরকান্দা ফকির বাড়ী কালুর দোকান হইতে সাঈদ খানের বাড়ী পর্যন্ত প্রকল্পের খোজ নিলে এমনই অভিযোগ পাওয়া যায়।প্রকল্পের শ্রমিক মিলন মিয়ার সাথে কথা হলে তিনি জানান এমন তথ্য। নিগুর কান্দার নুরুল ইসলামের পুত্র শ্রমিক মিলন বলে-এই রাস্তার প্রকল্পে তারা ১৫-২০দিন কাজ করেছে। ব্যাংক থেকে ৭ হাজার টাকা করে উত্তোলন করলেও তাদের কে দেওয়া হয়েছে ৪হাজার টাকা করে। বাকী টাকা ওয়ার্ডের মেম্বারের নিয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
এব্যাপারে চেয়ারম্যান সাঈদের সাথে কথা হলে তিনি জানান-মুজুরীর টাকা উত্তোলনের জন্য শ্রমিক তালিকা ব্যাংকে পাঠানো হলেও ব্যাংক টাকা দিচ্ছেনা।ব্যাংক টাকা দিতে টালবাহানা করায় বিষয়টি ইউএনও স্যারকে জানানোর পরেও টাকা দেয়নি ব্যাংক।
 ত্রিশালের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিয়ন মোক্ষপুর।উপজেলা জেলা সদর থেকে একটু দুরে বিধায় এই ইউনিয়নে চেয়ারম্যান তার মনগড়া মতই যখন যেভাবে খুশী কাজ করছে। এই ইউনিয়নের কর্মসুচীর তালিকায় ৩৭৬ জনের নাম থাকলেও কাজ করেছে নামমাত্র কয়েকজন। তাও ২৫০০ (আড়াই হাজার টাকা)কন্ট্রাক্ট ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। ইউনিয়নের কারণ বাড়ী থেকে জমতলী ফাজিল মাদ্রাসা পর্যন্ত রাস্তা প্রকল্পের শ্রমিক জামতলী এলাকার হুসেন আলীর ছেলে আব্দুল্লাহ এর সাথে কথা হয়। সে জানায়-এই প্রকল্পে তার ১০-১২জন শ্রমিক কাজ করেছে। তাদেরকে কন্ট্রাক্ট করা হয়েছে ২৫০০টাকা করেছে। তবে গত ৫মাস পুর্বে কাজ শেষ হলেও এখনো মুজুরীর টাকা না পেয়ে করোনার এই দুঃসময়ে কষ্টে আছেন তিনি। আব্দুল্লা জানায়-মেম্বারকে মুজুরীর  টাকার বিষয়ে বললে মেম্বার জানায় সরকার এখনো টাকা দেয়নি, দিলে দিয়ে দিবো। মৃত কাজিম উদ্দীনের স্ত্রী শ্রমিক বেদেনা খাতুনের সাথে কথা হলে সে জানায়-তারা মাত্র ১০দিন কাজ করেছেন। দৈনিক ২৫০টাকা হারে ১০দিনের টাকা দেওয়ার চুক্তি থাকলেও সে তার টাকা পায়নি।তাকে জানানো হয় সরকার টাকা দেয়নি।
তবে এসব ব্যাপারে ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কালামের কাছে জানতে চাইলে-তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এব্যাপারে যোগাযোগ করলে কাশিগন্জ কৃষি ব্যাংক শাখার সাবেক ম্যানেজার মোসলেম উদ্দিন বলেন, গত ২৩/০৬/২০২০তারিখে শ্রমিকদের নিজ নিজ একাউন্ট হোল্ডারে টাকা জমা হয়েছে। পরবর্তীতে হরিরামপুর ইউনিয়নের ৬১জন শ্রমিক টাকা উঠাইয়াছে। আমি দায়িত্ব থাকা অবস্থায় আর কোন শ্রমিক ব্যাংকে আসেনি।
 বর্তমান ম্যানেজার কাজল চন্দ্র সরকার বলেন, একাউন্ট হোল্ডার নিজে আসলে টাকা উঠাইয়া নিতে পারবে।
মোক্ষপুর ইউনিয়ন ট্যাগ অফিসার উপজেলা সিনিয়র দারিদ্র্য বিমোচন কর্মকর্তা মোঃ গাজিউর রহমান বলেন, সবগুলো প্রকল্প পরিদর্শন করা সম্ভব হয়নি। চেয়ারম্যানের কিছু রাস্তার কাজে সমস্যা ছিলো, পরে করিয়ে নিবেন।
হরিরামপুর ইউনিয়নের ট্যাগ অফিসার সহকারী   উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ জহির আলম বলেন, প্রকল্পগুলো পরিদর্শন করেছি। কাজে কোন সমস্যা নেই। শ্রমিকদের মজুরির ব্যাপারে  চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলেন।
আমিরাবাড়ী ইউনিয়নের ট্যাগ অফিসার উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা শাওন মজুমদার বলেন, আমি সবগুলো প্রকল্প পরিদর্শন করেছি, কিন্তু কিছু কিছু সমস্যা ছিলো। পরে আমি পুনরায় কাজ করিয়ে নিয়েছি। শ্রমিকদের মজুরি বিষয়ে তিনি বলেন, এটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান  এবং ব্যাংকের ব্যাপার। আমার যা করনীয় আমি করে দিয়েছি।
এসব ব্যাপারে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আলমগীর কবিরের কাছে জানতে চাইলে তিনি  প্রতিনিধির সাথে কোন কথা বলতে রাজী না হয়ে দেখিয়ে দেন তার পাশের রুমে থাকা অফিস সহকারীকে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান জানান, কর্মসুচীর কাজ হয়েছে আমার যোগদানের পুর্বে। আমি যোগদান করার পর এই ধরণের কোন সমস্যার ব্যাপারে আমাকে কেউ কিছু বলেননি। এখন জানতে পেরেছি, তাই ঈদের আগেই ব্যবস্থা নিব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!