হিলি প্রতিনিধিঃ
ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানেই খুশি। সবাই সবার মাঝে ভাগাভাগি করবে ঈদের আনন্দ আর খুশি। কিন্তু এই সব আনন্দ ও খুশির অর্থয় বা কি, জানে না দিনাজপুরের হিলির দক্ষিণ বাসুদেব পুর (মহিলা কলেজ পাড়া) গ্রামের মৃত সোহরাফ হোসেনের স্ত্রী জাহানারা বেগম (৪৮)।
২৮ বছর হলো তার স্বামী মারা গেছে, রেখে গেছে দুই মেয়ে আর এক ছেলে। অল্প বয়সে স্বামী হারিয়ে দিশেহারা তিনি, বিপাকে পড়েছে ছোট ছোট তিন সন্তানকে নিয়ে। বাচ্চাদের মুখে খাবার তুলে দিবেন এমন খাবার ছিলো তার ঘরে। আত্মীয় স্বজনদের অবহেলা আর অবজ্ঞার মাঝে বড় হতে থাকে ছেলে-মেয়েরা। কয়েক বছর পর বড় মেয়েকে মানুষের কাছে সাহায্য নিয়ে বিয়ে দেয় তিনি। বাঁকি থাকে মেঝ মেয়ে আর কোলের ছেলে সন্তান নুরনবী।
মানুষের বাড়ি আর ইট ভাটায় রান্নার কাজ করে দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে চলেছেন তিনি কোন রকম। শেষে যখন আর কোন কাজ না পায়, নিরুপায় হয়ে কোলের ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে জীবিকার সন্ধানে পাড়ি জমায় ঢাকা শহরে। নতুন আজব শহর ঢাকা, কোন কিছু চেনেন না তিনি। পরে কাজ জোগাড় করে নেয় পোশাক কারখানায়। শুরু হয় তার নতুন জীবন, গ্রামের মেয়ে, শহরে গিয়ে অনেকটা ভিতু অবস্থায় থাকে। এভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, আর বছরের পর বছর পার হতে থাকে। মেঝ মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হয়ে উঠে। দেখে শুনে বিয়ে দেয় মেয়েকে।
বাঁকি থাকে জীবনের একমাত্র অবলম্বন ছোট ছেলে নুরনবী। বয়স এখন তার ১৭ বছর, দেখতে প্রিন্সের মতো। যত বড় হচ্ছে ততই যেন স্বপ্ন জাগছে এই জনমদুখিনী জাহানারা বেগম ছেলেকে নিয়ে। তিনি কল্পনা করেন স্বামী হারিয়ে অনেক ঘাত প্রতিঘাত আর মানুষের লাথি-ঘুতা খেয়ে এতো দুর এসেছি। আজ আমার ছেলে বড় হয়ে যাচ্ছে, আর হয় তো কয়েক বছর পর সে কাজ করতে পারবে। আমার আর কোন দুঃখ কষ্ট থাকবে না। নুরনবীর বয়স এখন ১৭ বছর, কাজ করার মতো সাহস ও শক্তি সঞ্চয় করেছে সে। তাই ট্রাকের হেলপারি করার কাজ শুরু করে সে। কর্মচঞ্চলতার কারণে অল্প দিনে গাড়ির ড্রাইভার হয়ে যায় নুরনবী।
নুরনবী এখন বাস ড্রাইভার, টাকা উপার্জন শুরু করেছে। মায়ের মুখে হাসি আর সুখের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। মার স্বপ্ন দেখের পরিমাণটা আরও বেড়ে যায়। ভাবে ছেলে আমার সুন্দর আর সুদর্শন। ভাল মেয়ে দেখে বিয়ে দিবো। আবার ফিরে যাবো স্বামীকে যে মাটিতে ঘুমিয়ে রেখেছি। জানি কোন দিনও স্বামীকে দেখতে পাবো না। কিন্তু ছেলে আর ছেলের সন্তান হলে তাদের মুখ দেখে বাঁকি জীবনটা কাটিয়ে দিবো।
হয়রে মুখপোড়া আশা আর স্বপ্ন, হঠাৎ মা জাহানারা বেগম সংবাদ পায় ছেলে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে।
নিমিষেই থমকে গেলো জীবনের সকল আশা আর একমাত্র ভরসা। থেমে গেলো বাঁকি জীবনের সকল চাওয়া পাওয়া। স্বামী আর সন্তান হারা এবং মেয়ে দুটো থেকেও নেই। দুনিয়াটা আজ তার কাছে অন্ধকার।
জীবন তো তার নিজেস্ব গতিতে চলবে। তাই একমাত্র ভরসা ছেলেকে হারিয়ে, ঢাকা শহর যে তার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছে। তাই আবার স্বামীর স্থানে ফিরে আসতে হয় তাকে। এক সময় এই হিলিতে স্বামী সন্তান সবি ছিলো তার। আজ কেউ নেই তার, একে বারে নিঃস্ব একাকিত্ব হয়ে গেছে মানুষটি।
দুঃখের কপালে সুখ স্বই না। হিলিতে বর্তমান তার মাথা গোজার কোন স্থান নেয়। আত্মীয় স্বজনরাও তাকে কোন সাহায্য সহযোগিতা করে না। প্রায় ৮ থেকে ১০ বছর যাবৎ মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করেন। আর যে যা দেয় তাই দিয়ে জীবন চলান তিনি। আবার কারও বাড়ির মেঝেতে বা বারান্দায় রাত কাটিয়ে দেন।
স্বামী হারা ২৮ বছর হলেও এখন পর্যন্ত বিধবা ভাতার কার্ড পায়নি জাহানারা বেগম এবং কি সরকারি সকল সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত তিনি।
আপনার ঈদ কেমন কাটলো? জানতে চাইলে অশ্রু ভেজা চোখে কান্না কণ্ঠে জাহানারা বেগম বলেন, ঈদ,ঈদ কি? আমি তো ঈদ ভুলে গেছি। কাদের নিয়ে ঈদ করবো? আমি তো একজন সর্বহারা জনমদুখিনী মা। স্বামী চলে গেছে, একটা স্বপ্নে দেখা ছেলে ছিলো, সেও তো আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। কাদের নিয়ে ঈদের আনন্দ উপভোগ করবো? আজ আমার বাড়ি-ঘর নেই। চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে, আমি এখন কাঁদতেও ভুলে গেছি। মানুষের বাড়িতে কাজ করি আর যে বাড়ির বারান্দা ফাঁকা থাকে সেই বারান্দায় রাত কাটিয়ে দেয়।
হাকিমপুর হিলি পৌর মেয়র জামিল হোসেন চলন্ত বলেন, জাহানারা বেগম একজন অসহায় মানুষ, তার বিধবা ভাতার কার্ড এবং একটি সরকারি ঘর পাওয়ার জন্য আমি সার্বিক সহযোগিতা করবো।
তিনি আরও বলেন, জাহানারা বেগমকে আমি ঈদের আগের দিন প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে খাদ্য সামগ্রী দিয়েছি।
এবিষয়ে হাকিমপুর (হিলি) উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ নুর-এ আলম বলেন, তিনি এতো অসহায় মানুষ, আমার জানা ছিলো না। এইসব অসহায় মানুষগুলোই সকল সরকারি সুবিধা পাওয়ার যোগ্য। জাহানার বেগমর সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। তার জন্য বিধবা ভাতার কার্ড এবং একটি সরকারি ঘর দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।