
কবি আরিফুজ্জামান
ইতিহাসে এমন কিছু দিন আছে, যা একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দেয়। তেমনই একটি দিন ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন, যার নাম পলাশীর যুদ্ধ। কিন্তু বাস্তবে এটি কোনো যুদ্ধ ছিল না—এটি ছিল এক নির্মম বিশ্বাসঘাতকতার ষড়যন্ত্র, এক জাতীয় বিপর্যয়ের সূচনা, যেখানে হারিয়ে গিয়েছিল বাংলার স্বাধীনতা, আত্মমর্যাদা এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা।
পলাশীর যুদ্ধ: প্রহসনের রক্তাক্ত পর্দা
২৩ জুন ১৭৫৭, নদীয়ার পলাশীর আম্রকাননে মুখোমুখি হয়েছিল দুটি বাহিনী—একদিকে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা, অপরদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ বাহিনী। নবাবের পক্ষে প্রায় ৫০,০০০ সৈন্য থাকলেও, ইংরেজদের ছিল মাত্র ৩,০০০ জন সৈন্য। সংখ্যার হিসাব অনুযায়ী বিজয় নবাবেরই হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ইতিহাস জানে—সেই যুদ্ধে জয়ী হয়েছিল প্রতারণা, পরাজিত হয়েছিল বিশ্বাস।
ব্রিটিশদের সঙ্গে চক্রান্ত করে মীরজাফর, জগৎশেঠ, উমিচাঁদ প্রমুখ নবাবকে ময়দানে একা ফেলে দেন। যুদ্ধে নয়, বাংলার স্বাধীনতা খুন হয়েছিল নিজেদেরই হাতে।
পলাশীর ফল: স্বাধীনতা থেকে পরাধীনতার পথে যাত্রা
পলাশীর যুদ্ধ শুধু এক দিনের পরাজয় ছিল না, এটি ছিল দুই শতকের পরাধীনতার দরজা খুলে দেওয়ার ঘটনাক্রম। বাংলার অর্থনীতি, প্রশাসন, শিক্ষা, শিল্প—সবই ধীরে ধীরে লুপ্ত হতে থাকে। ব্রিটিশ শাসনের শোষণমূলক নীতির ফলে এক সমৃদ্ধ সভ্যতা রূপ নেয় করুণ অস্তিত্বে।
এই যুদ্ধ আমাদের শিখিয়ে দেয়— যুদ্ধের জন্য বাহিরের শত্রু যতটা ভয়ংকর নয়, ভিতরের বিশ্বাসঘাতকরাই সবচেয়ে বিপজ্জনক।
নবাব সিরাজউদ্দৌলা
এক আত্মমর্যাদার প্রতীক
বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন কেবল এক তরুণ নবাব নন, তিনি ছিলেন একজন অকুতোভয় দেশপ্রেমিক, দুর্নীতির বিরোধী, সাহসী সংস্কারক। মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই কোম্পানির অবৈধ প্রভাব, ভ্রষ্ট রাজকর্মচারী ও সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন।
তাঁর এই সততা, দৃঢ়তা ও স্পষ্টভাষী মনোভাব শত্রু তৈরি করে দেয় তাঁর চারপাশে—আর সেই শত্রুরাই একদিন তাঁকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়।
তিনি যখন পালাতে বাধ্য হন, তখন তাঁর আত্মার ভিতরে জ্বলছিল বাংলার জন্য এক শুদ্ধ আগুন। কিন্তু সেই আগুন নিভিয়ে দেওয়া হয়েছিল বিশ্বাসঘাতকতার ছাই দিয়ে।
নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হয়েছিলেন বন্দুকের গুলিতে নয়, বরং বিশ্বাসের গুলিতে। কিন্তু ইতিহাসে তিনি চিরকাল স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদার দীপ্ত প্রতীক হয়ে থাকবেন।
স্মরণ নয়, শপথ হোক পলাশীর পাঠ
পলাশীর যুদ্ধ শুধু ইতিহাসের পাঠ নয়—এটি একটি সতর্কবার্তা। এটি মনে করিয়ে দেয়, যে জাতি ভিতর থেকে দুর্বল, তার পক্ষে বাহিরের শক্তিকে রুখে দাঁড়ানো সম্ভব নয়।
২৩ জুন তাই শুধু শোকের দিন নয়, এটি একটি আত্মবিশ্লেষণের দিন, আত্মমর্যাদা রক্ষার শপথ নেওয়ার দিন।
আজ, আমরা যখন পলাশীর কথা বলি, তখন কেবল একটি যুদ্ধ নয়, একটি আত্মবিরোধী সমাজের প্রতিচ্ছবি দেখি।
আজ, আমরা যখন নবাব সিরাজউদ্দৌলার কথা স্মরণ করি, তখন কেবল একজন পরাজিত নবাব নয়, একজন অটল দেশপ্রেমিকের আত্মবলিদান স্মরণ করি।
শ্রদ্ধাঞ্জলি
শ্রদ্ধা হে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব, সিরাজউদ্দৌলা!
আপনার রক্ত ঝরেছিল, কিন্তু মাথা নত হয়নি।
আপনার মৃত্যু হয়েছিল, কিন্তু আত্মমর্যাদা অটুট ছিল।
আপনি ইতিহাসের পাতায় বেদনাবিধুর এক নাম,
তবু বাংলার হৃদয়ে আপনি চিরকাল অজেয় সাহসের দীপ্তি।
আমরা ভুলিনি। আমরা ভুলবো না।