Header Image

মেম্বারকে তুলে নিয়ে যেভাবে হত্যা করেন ওসি প্রদীপ!

খায়রুল আলম রফিকঃ

২৩ জুলাই রাত প্রায় পৌণে ৩টা। নিশুতি রাত। বাড়ির সবাই তখন ঘুমিয়ে। ঠিক ওই সময়ে বাড়ির দরজায় হাজির ওসি প্রদীপ কুমার দাস। সাথে তাঁর আরেক ওসি মর্জিনা আক্তার। প্রথমজন টেকনাফ থানার বহুল আলোচিত-বিতর্কিত ওসি। অন্যজন উখিয়ার থানার ওসি।

‘বখতিয়ার ভাই, একটু বের হবেন! একজন মানুষকে শনাক্ত করতে হবে। আপনি চেনেন কিনা!’

ওসি প্রদীপের পরিচয় পাওয়ার পর বাড়ির দরজা খুলে দেন বখতিয়ার মেম্বার। তিনি উখিয়া উপজেলার কুতুপালং ইউনিয়নের ৯ নাম্বার ওয়ার্ডের নির্বাচিত মেম্বার। যিনি টানা তিনবার ধরে নির্বাচিত হয়ে আসছেন।

বাড়ির দরজা খুলতেই দুইজন পুলিশ ছোঁ মেরে বখতিয়ার মেম্বারকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে নেন। দ্রুত পুলিশের গাড়িতে তুলে নেন। তাঁকে তুলে নিয়েই পুলিশের গাড়ি যাত্রা করে।

তখন বাড়িতে থাকা বখতিয়ার মেম্বারের তিন ছেলের মধ্যে মেজো ছেলে হেলাল উদ্দিন বাবার বিষয়টি জানতে ফোন দেন ওসি প্রদীপকে। ওসি প্রদীপ কুমার দাশ দুইবার ফোন রিসিভও করেছিলেন। তখন তার (হেলাল উদ্দিন) বাবার জন্য যতটুকু সম্ভব করার আশ্বাসও দেন তিনি।

পরদিন সকালে টেকনাফ থানাসহ উখিয়া ও কক্সবাজারের বেশ কয়েকটি থানায় খোঁজ নেয় বখতিয়ার মেম্বারের ছেলে ও আত্মীয়-পরিজনরা। কিন্তু কোথাও বখতিয়ার মেম্বারের খোঁজ নেই।

পরে বিকেলে খবর আসে বখতিয়ার মেম্বারকে টেকনাফ থানায় নেয়া হয়েছে। বাবার জন্য টেকনাফে ছুটে যান ছেলে হেলাল উদ্দিন। নানাজনের মাধ্যমে পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের কাছে দেনদরবার করেন। অনেকে আশ্বস্থও করেন তাঁকে (বখতিয়ার মেম্বার) ছেড়ে দেয়া হবে। ওসি প্রদীপের হয়ে মোটা অংকের লেনদেনের প্রস্তাবও আসে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিণতি না পাওয়ায় টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশের নেতৃত্বে একদল পুলিশ রাত ৮টার দিকে আবারও বখতিয়ার মেম্বারের বাড়িতে হানা দেয়।
এবার বাড়িতে ঢুকেই বখতেয়ার মেম্বারের সহধর্মিনী শাহানা আক্তারের হাতে পরিয়ে দেন হাতকড়া। শুরু করা হয় মানসিক, শারিরিক নির্যাতন। সাথে অকথ্য গালিগালাজ। ওই সময় বখতেয়ার মেম্বারের কলেজ পড়ুয়া মেয়ে ও দুই পুত্রবধূকে চর-থাপ্পড় ও শ্লীলতাহানি করেন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও সাথে থাকা অন্য পুলিশরা। লজ্জায় যে কথা কাউকে বলতে পারেননি তারা।

তারপর বাড়ির আলমিরা ভেঙ্গে লুট করা হয় ৫১ লাখ নগদ টাকা, অসংখ্য জমির দলিল ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র। ওই সময় বখতিয়ার মেম্বারকে পুলিশের সাথে আনা হলেও তাঁকে গাড়িতেই বসিয়ে রাখা হয়।

বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট আর নারীদের শ্লীলতাহানির পর বখতিয়ার মেম্বারকে নিয়ে ফিরে যায় ওসি প্রদীপের নেতৃত্বাধীন পুলিশের দল।

তারপরও মোটা অংকের প্রস্তাব আসতে থাকে পুলিশের পক্ষ থেকে। কিন্তু বখতিয়ার মেম্বারের পরিবারের পক্ষ থেকে কোন সাড়া পায়নি পুলিশ।

রাত গভীর হয়। রাত তখন প্রায় আড়াইটা। বখতিয়ার মেম্বারের পরিবারের সদস্যদের কাছে মোবাইলে খবর আসে তাঁকে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলা হয়েছে।

ঠিক এভাবেই আলোচিত বখতিয়ার মেম্বারকে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ‘হত্যা’র বিবরণ তুলে ধরেছেন তাঁর সহধর্মিনী শাহানা আক্তার।

পাঁচ সন্তানের এই জননী সাংবাদিকদের সামনে এই বিবরণ তুলে ধরে দাবি করেন, তাঁর স্বামী বখতিয়ার মেম্বারের বিরুদ্ধে থানায় কোন মামলা ছিল না। তিনি ইয়াবা কারবারেও জড়িত ছিলেন না। তিনি মূলতঃ কুতুপালং ইউনিয়নের ৯ নাম্বার ওয়ার্ডের মেম্বার হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নিজের ব্যবসায়িক কাজ-কর্ম করে দিনাতিপাত করতেন।

শাহিনা আকতার দাবি করেন, তার স্বামী স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ প্রায় দুই বছর ধরে অসুস্থ ছিলেন। পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত তিনি বেশির ভাগ সময় বাড়িতেই কাটাতেন আর চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

তিনি মনে করেন, তাঁর স্বামী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সামাজিক শত্রুদের দ্বারা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন। তাদের দ্বারাই প্রভাবিত হয়ে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ একজন অসুস্থ মানুষকে (বখতিয়ার মেম্বার) দুই রাত ও একদিন নির্যাতন চালিয়ে সুস্থ মস্তিস্কে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেছেন।

সুত্র মতে, গত ২৩ জুলাই দিবাগত রাত পৌণে ৩টার দিকে ওসি প্রদীপ কুমার দাস কুতুপালং এলাকার নিজের বাড়ি থেকে নিয়ে যান। পরদিন দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে টেকনাফে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ সাজিয়ে বখতিয়ার মেম্বারের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।

মৌলভী বখতিয়ারের স্ত্রী শাহিনা আকতার জানান, ওসি প্রদীপের হুমকি, ধমকিতে ভীত হয়ে এতদিন তারা মুখ খুলতে পারেননি। এমনকি হঠাৎ ক্রসফায়ারে স্বামীকে হারিয়েও তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা বাড়িতে অবস্থান করতে পারছেন না। দিনে রাতে পুলিশসহ কোন না কোন বাহিনীর লোকজন এসে তাদের নানাভাবে হয়রানি করছে।

তিনি জানান, তার স্বামীকে হত্যা করেই ওসি প্রদীপ নিজের অপকর্ম থামাননি। তার তিন ছেলেকেও ক্রসফায়ার, মাদক মামলাসহ তিনটি মামলায় আসামি করা হয়েছে।

কোন মামলা নেই, তবুও ক্রসফায়ার
স্ত্রী শাহিনা আকতার দাবি করেন, তাঁর স্বামী বখতিয়ার মেম্বারের ইয়াবা কিংবা মাদক মামলা তো দূরের কথা, অন্য কোন মামলাই নেই। অথচ ওসি প্রদীপ কুমার তার স্বামীকে তুলে নিয়ে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ সাজিয়ে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেছেন।

তিনি প্রশ্ন তুলেন, কোন ধরণের অভিযোগ ছাড়াই একজন মানুষকে কিভাবে হত্যা করা যায়!

ঘর থেকেও বাইরে রাতযাপন
বখতিয়ার মেম্বারের পাঁচ ছেলে-মেয়ের মধ্যে তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। তাদের মধ্যে এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে। আরেকজন কলেজে পড়েন। তিন ছেলের মধ্যে বড় ছেলে আইনজীবী ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএমে কর্মরত, মেজো ছেলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ও কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের ছাত্র এবং ছোট ছেলে চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির ছাত্র।

বাবা বখতিয়ার মেম্বারকে হারানোর পরও ওসি প্রদীপ কুমার দাশের ভয়ে-আতংকে বাইরে রাত কাটাতে হচ্ছে। শুধু ছেলে-মেয়েরা নয়, শাহিনা আকতার নিজেও পুলিশের ভয়ে আত্মীয় স্বজনের ঘরে রাত কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন।

তিনি তাঁর স্বামী হত্যার বিচার চান। প্রয়োজনে হত্যা মামলা করবেন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!