বিশেষ প্রতিনিধি :
অধিকার বঞ্চিত তিন শতাধিক টোকাই, ছিন্নমূল, ভবঘুরে বা পথশিশুর বন্দি জীবন কাটে ত্রিশাল উপজেলার সীমানাবর্তী ধলা গ্রামের জমিদার বাড়ির সরকারি আশ্রয়ণ কেন্দ্রে।
বছরের পর বছর ধরে তারা সেখানে থাকলেও একদিনের জন্যও পরিবারের কেউ তাদের দেখতে আসেনি। নিয়তি তাদের প্রতিদিনই কাঁদায়। ঈদের দিনেও কাঁদে তারা। পিতা-মাতা, ভাই-বোন ছাড়া ঈদের আনন্দ তাদের স্পর্শ করে না। এদের অধিকাংশের বাড়ি নদী ভাঙনকবলিত এলাকা দরিদ্র এলাকায়।
অনেকের বা-মা রিকশা, ঠেলাগাড়ি চালায়, ইটভাটায় কিংবা বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে। এসব দরিদ্র পরিবারের শিশুরা শৈশবের শুরুতেই আয়-রোজগারের আশায় আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর হাত ধরে পাড়ি জমায় শহরে। এক সময় জীবন থেকে হারিয়ে যায়।
আজ সকাল বেলা ধলা জমিদার বাড়িতে সরকারি আশ্রয়ণ কেন্দ্রের ডরমেটরীর সামনে উপস্থিত হলে তালাবদ্ধ বারান্দার গ্রিলের ভিতরে অবস্থানকারীদের কয়েকজন আশ্রিত শিশু চিত্কার করে কাঁদতে কাঁদতে বলছিল স্যার আমাদের এখান থেকে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। ঈদের দিনও বাপ-মা’র সাথে বসে খেতে পারিনি। জানি না তারা কেমন আছে এখন । এ সময় তাদেরই মতো আশ্রিত তাদের দুজন সর্দার এসে তাদেরকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে বারান্দা থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়।
১৩ বছর বয়সী একটি ছেলে । ৮ বছর ধরে এই আশ্রয় কেন্দ্রে। বাড়ি নোয়াখালীর সোনাপুরের চরমুদ্দিন গ্রামে। বাবা ইউসুফ, মা কোহিনুর। ৫ বছর বয়সের সময় থেকে ঢাকার একটি হোটেলে কাজ করত। থাকত এয়ারপোর্ট স্টেশনে। সেখান থেকে ধরে পুলিশ এখানে দিয়ে গেছে। বাধ্য হয়েই বাবা-মা ছাড়া ৮ বছর ধরে এখানে ঈদ করছে। অন্য কোনোদিন না হলেও ঈদের দিন তার বা-মা ও বাড়ির কথা বেশি মনে পড়ে। এই দিন চোখে পানি আসে কথাগুলো বলতে বলতে দুই চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরে শিশুটির।
১৫ বছর বয়সী রাজিব। বাড়ি বরিশাল। ১০ বছর আগে ছোট ভাই সাজেদুলকে মা রেবেকা’র কোলে দেখে এসেছিল। বাড়িতে থাকতে বাবার কোলে-কাঁধে ঈদের মাঠে গিয়েছে। গত ১০ বছরে কোনোদিন ঈদগাঁ মাঠে গিয়ে নামাজ পড়তে পারেনি।
মনোহরদির মাসুম (১৬) আক্ষেপ করে জানায়, অনেকদিন এখানকার কাশেম স্যারের মোবাইল দিয়ে বাবা-মা’র সাথে কথা বলেছে। ঈদের দিন কাশেম স্যার না আসায় বাবা-মা’র সাথে কথা বলতে পারেনি।
জানা গেছে, ঈদের দিনের জন্য আশ্রিতদের আলাদা কোনো বরাদ্দ নেই। প্রতিমাসে একজন আশ্রিতের জন্য খাবার, পোশাক, চিকিৎসাসহ ২৬০০ টাকা বরাদ্ধ। ঈদের দিন তাদের জন্য সেমাই, পোলাও, মাংস, ভূনা খিচুড়িসহ বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। নতুন লুঙ্গি, গামছা ও শাট দেয়া হয়। অতিরিক্ত যে খরচ হয় অন্যান্য দিনে ও মাসে খরচ কমিয়ে সমম্বয় করা হয়।
ঈদের দিনটাও তাদের কাছে অন্যান্য দিনের মতো স্বাভাবিক। ঈদের দিনের জমিদার বাড়ির ডরমেটরির ১২টি রুমে ৩০০ জনকে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। ডরমেটরির কলাপসিবল গেট থেকে বের হয়ে জমিদারবাড়ি, বিশাল সবুজ মাঠ, গাছ-গাছালী, শান-বাঁধানো পুকুর ঘাট কিংবাা বড় বড় পুকুর কোথাও যাওয়ার অনুমতি নেই তাদের। কলাপসিবল গেটের রড ধরে, বুকের ভেতর পাথর চেপে বাবা-মা, ভাই-বোনের পথ চেয়ে হয়তো বেশি প্রত্যাশা নিয়ে প্রতীক্ষা করে ঈদের দিনটি কাটিয়ে দেয় তারা।
এ বিষয়ে ত্রিশাল উপজেলা নির্বাহি অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান জানান, আমি শুনেছি খুব শীঘ্রই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।