Header Image

প্রাথমিক শিক্ষা কারিকুলাম ২০২৩: বাস্তবায়ন ও চ্যালেঞ্জ

 

২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখাটি নীতিগত অনুমোদন দিয়েছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ৩০ মে ২০২২ এ কারিকুলাম চূড়ান্তভাবে অনুমোদন দেয় জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটি (এনসিসিসি)। আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে প্রণয়ন করা হয় এই রূপরেখা।

জীবন ও বাস্তবমুখী শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে এই কারিকুলামের মাধ্যমে, সংযুক্ত করা হয়েছে নতুন ৯ টি বিষয়। সংশোধন করা হয়েছে বেশকিছু সিদ্ধান্ত। যেমন- দশম শ্রেণীর আগে নেই কোনো পাবলিক পরীক্ষা। উচ্চমাধ্যমিকের আগ পর্যন্ত থাকবেনা বিভাগ ভিত্তিক পড়াশুনা। ষষ্ঠ থেকে দশম পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা ১০ টি অভিন্ন বিষয়ে পড়বে। তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকবে না। মূল্যায়ন হবে শিখন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। নতুন শিক্ষাক্রমে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ও সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক ভিত্তিতে সারা বছর ধরে ধারাবাহিক মূল্যায়ন থাকবে। রয়েছে পেশাভিত্তিক শিক্ষা যেন দশম শ্রেণী শেষে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর একটি করে পেশায় দক্ষতা তৈরি হয়। সকল শিক্ষার্থীকে সকল ধর্মের বই পড়ানো হবে যা যুগোপযোগী, ধর্মীয় শ্রদ্ধাবোধ তৈরি, অসাম্প্রদায়িক মনোভাব তৈরিতে সহায়তা করবে। এ বছর থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ৪ টি শ্রেণীতে এটি চালু হচ্ছে।

২০২৭ সাল থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পুরোপুরি এটি বাস্তবায়িত হবে। ইতোমধ্যে, সারাদেশে ৬১ টি স্কুল, কারিগরি ও মাদ্রাসায় পাইলটিং করা হয়েছে। এছাড়াও, ব্লেন্ডেড লার্নিং বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এই রূপরেখায়।

নতুন এই কারিকুলাম বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে যা মোকাবিলা করা অত্যন্ত জরুরী। যদিও এটি বাস্তবায়নের আগে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো প্রস্তুতসহ ১১টি বিষয় বাস্তবায়ন আবশ্যক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে সংশ্লিষ্ট রূপরেখায়।
উল্লিখিত শিক্ষা কারিকুলামের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ শিক্ষক সংকট। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর পরিসংখ্যানের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে সরকারি, বেসরকারি কিন্ডারগার্ডেন ও এনজিও পরিচালিত বিদ্যালয়সহ মোট প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ১ লাখ ২৯ হাজার ২৫৮টি এবং শিক্ষার্থী প্রায় ২ কোটি। এর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৬৫ হাজার ৬২০টি, শিক্ষক ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৩৬৬ জন এবং শিক্ষার্থী ১ কোটি ৪১ লাখ ৪৪৫ জন। দেখা যায়, সারা দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গড়ে ১ জন শিক্ষকের বিপরীতে ৩৯ জনের মতো শিক্ষার্থী রয়েছে। দেশে ২০ হাজার ৬০০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ১ কোটি ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৩২৩ জন এবং শিক্ষক ২ লাখ ৪৬ হাজার ৮৪৫ জন। অর্থাৎ ১ জন শিক্ষকের বিপরীতে শিক্ষার্থী প্রায় ৪২ জন। এছাড়াও ৪ হাজার ৫৫১টি কলেজে মোট শিক্ষার্থী রয়েছে ৪৩ লাখ ৮৫ হাজার ২১০ এবং শিক্ষক ১ লাখ ২৭ হাজার ৭৬৭ জন
(ব্যানবেইস)। এছাড়াও বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক সংকট তো রয়েছেই।

গ্রামের স্কুলগুলোতে ই সংকটটি প্রকট হয়ে দাঁড়াবে। ফলে শহর ও গ্রামে মানসম্মত শিক্ষায় একটা বৈষম্য তৈরি হবে। তাই এটি এড়াতে সকল স্কুলে প্রয়োজন অনুযায়ী বিভাগ ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।

শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের বিষয়টিও গুরুত্বের সংগে উল্লেখ করা হয়েছে। নতুন কারিকুলামের সাথে শিক্ষার্থীদের মেলবন্ধনে প্রয়োজন অধিক যোগ্যতা ও দক্ষতাসম্পন্ন শিক্ষক। তাই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটা নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকল শিক্ষকের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করা এই সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নতুন শিক্ষা কারিকুলামের সাথে শিক্ষার্থীরা যাতে খাপ খাইয়ে নিতে পারে তার জন্য তৈরি করা হয়েছে ‘টিচার গাইড’। টিচার গাউড অনুসরণ করে শিক্ষকোরা প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা প্রদান করবেন শিক্ষার্থীদের।

নতুন কারিকুলামের সাথে যুক্ত হয়েছে আইসিটি ও বিজ্ঞানের নিত্য নতুন আবিষ্কার। এর জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো ও দক্ষ জনবল। তাই প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা নিশ্চিত করা নতুন কারিকুলামের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আরও উন্নত ও বাস্তবসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় নিয়ামক মানসম্মত বই তৈরি। শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তক যদি কারিকুলামের সাথে সংগতিপূর্ণ না হয় তাহলে পুরো পরিকল্পনাই অধরা রয়ে যাবে। তাই নতুন পাঠ্যপুস্তক নির্ধারণ বড় একটি চ্যালেঞ্জ।
অভিভাবকদের সচেতনতার বিষয়টিও গুরুত্বের সংগে বিবেচনা করতে হবে। কারন নতুন শিক্ষাক্রমের সাথে ছাত্রছাত্রীদের পরিচিত করা ও তাদের উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করবেন অভিভাবকেরাই। তাই অভিভাবকদের নতুন কারিকুলামের ইতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে জানাতে হবে ও সচেতন করতে হবে।
কোনো পরিকল্পনা তৈরির পর উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ হলো তা যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়া অর্থাৎ কিছুদিনের মধ্যেই সকল উদ্যমের অবসান ঘটিয়ে তা মুখ থুবড়ে পড়া। কাজেই নতুন কারিকুলামের বাস্তবায়ন যেন যথাযথ হয় ও প্রত্যেকটি নির্দেশনা মেনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় তার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে বিদ্যালয় এবং শিক্ষকদের নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। ২০৪১ সালে বাংলাদেশ হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক ও তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর। বর্তমান শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীগণ মানবিক মানুষ হয়ে তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়ে বিশ্ব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষমতা অর্জন করবে।

মো: মোস্তাফিজার রহমান
জেলা প্রশাসক, ময়মনসিংহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!