Header Image

কারাগারে যত টাকা দেবেন, তত সুবিধা!

বিশেষ সংবাদদাতা :

কারাগারে যত টাকা দেবেন, তত ভিআইপি সুবিধা পাবেন। বন্দিরা কে কত টাকা দিতে পারছেন, তার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় তিনি কতটা সুযোগ-সুবিধা পাবেন। বেআইনি সেসব সুযোগ-সুবিধা দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন কারাগারের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, কারারক্ষী । ক্যান্টিন, কোয়ারেন্টিন, চিকিৎসা—এসব নিয়েও চলছে ব্যাপক বাণিজ্য।

কারাগারের বিভিন্ন সেল, হাসপাতাল আরামে থাকার জন্য আদায় করা হচ্ছে উচ্চ হারে ভাড়া। হাসপাতালে থাকার কথা রোগী, থাকেন মাদক ব্যবসায়ী,জামাত – শিবির, বিএনপির নেতা ও দুর্নীতিবাজরা। টাকা দিলে সেখানে সব মেলে! প্রভাবশালী ও বিত্তবান বন্দিদের জন্য সেখানে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা উন্মুক্ত। এ কথাগুলো বলেছেন সম্প্রতি শেরপুর ও জামালপুর কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হওয়া ৮ ব্যক্তি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাংবাদিকদের কাছে কারাগারের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরেন তারা। ওই ভুক্তভোগীরা বলেন, কারাগারের কেন্টিন ও হাসপাতালকে কেন্দ্র করে প্রতিদিন দুর্নীতিবাজ কারা কর্মকর্তাদের এক লাখ টাকা থেকে গড়ে প্রতিদিন চার লাখ টাকা পর্যন্ত আয় হয়।

 

সেলগুলোতে অবস্থান করেন বিত্তবান ও জেলার শীর্ষ মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত এমন বন্দিরা।
শেরপুর কারাগারে নকলার বিএনপির শীর্ষ নেতা ও সাবেক কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ওপর হামলাকারী চন্দ্রকোনার চেয়ারম্যানের ছেলেরা ও বিত্তবান বিশেষ সুপারিশের বন্দি ছাড়া ওই সেল ও হাসপাতালে অবস্থানের সুযোগ নেই। জামিনে মুক্ত পাওয়া ব্যক্তিরা জানান,সেলে বা কারা হাসপাতালে থাকবে তা কারাগারে প্রবেশের পর আমদানি সেল থেকে নির্ধারণ করা হয়। আমদানি সেলেই ভালো থাকা, ভালো পরা ও ভালো খাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয় বন্দিদের। এই ভালো থাকা, খাওয়া ও পরার কয়েকটি শ্রেণি রয়েছে। সপ্তাহ হিসেবে নগদ টাকা নেওয়া হয়। ভাল থাকতে হলে মাসে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা লাগে। লেনদেন নগদে ও বিকাশে হয়।

 

ধারে কোনো কারবার নেই। বিকাশের মাধ্যমেও চাহিদা পূরণ করা যায়। বাড়তি আরো কিছু সুবিধা পেতে বিএনপির ভিআইপি ও মাদক কারবারি বন্দিদের সপ্তাহে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়। এসব ভিআইপি বন্দি সহজেই কারা কর্মকর্তাদের কক্ষে প্রবেশের অনুমতি পান। সেখানে তাঁরা কী সুবিধা লাভ করেন, তা নিয়ে অনেক গুঞ্জন আছে। তারা বলেন, আমদানি সেল আর কেইস টেবিলে কোন বন্দি কত টাকা দিতে পারবে, তাদের সম্পদের পরিমাণ কেমন সে তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। বড় ধরনের অপরাধে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে গণমাধ্যম থেকেও তথ্য সংগ্রহ করা হয়। জেল গেট দিয়ে ঢুকলে তল্লাশির সময় বন্দির কাছে যা কিছু থাকে সব রেখে দেয়া হয় । নগদ টাকা নিয়ে না ঢুকলে পরিবারের লোকজনের কাছে ফোন করিয়ে টাকা আনার ব্যবস্থা করা হয়। এমন একটি অডিও দৈনিক আমাদের কন্ঠের হাতে এসেছে।

আবার জামিন হলে বন্দিদের স্বজনদের কাছ থেকে গেইটে মোটা অংকের টাকা নেয় কারাগারের জামিন শাখার স্টাফরা । অনুসন্ধানে জানাযায়, ২০১৮ সালে ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগারে বিজ্ঞ আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পাওয়া বন্দিদের আবারো গ্রেপ্তারের পুলিশের ভয় দেখিয়ে মোটা অংকের টাকা আদায় করতেন। এসব অভিযোগ জানাজানি হলে কর্তৃপক্ষ কারারক্ষী মেহেদী হাসানকে নেত্রকোনা জেলা কারাগারে বদলি করেন।
কারারক্ষী মেহেদী হাসান দুর্নীতি ও অনিয়ম করে কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে ভাবে অর্জন করেছেন । মেহেদী হাসানসহ ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগারের কয়েকজন কারারক্ষী ও কর্মকর্তার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করছেন দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক। সরেজমিনে গিয়ে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

কেউ কেউ দীর্ঘদিন ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগারে কর্মরত থেকে বিলাসবহুল বাড়ি, জমি ক্রয়,স্ত্রী-সন্তানদের নামে কোটি কোটি টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন । এমনকি অনেকে বিভিন্ন অপকর্মের সাথে জড়িত হওয়ায় বিভাগীয় মামলার সম্মুখীন হয়েছেন । অভিযোগ রয়েছে, ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগারে ২০২০ সালে সিআইডিতে কর্মরত মোঃ মোশাররফ হোসেন একাধিক বন্দিকে কেইস টেবিলে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে তাদের কাছ থেকে বেনসন সিগারেট আদায় করেন এর মুল হোতা ছিল সুবেদার বাবুল,তাকে অনিয়মের দায়ে রেঞ্জের বাইরে বদলি করেন । করোনা মহামারিতে এখন জামালপুর ও শেরপুর কারা কর্মকর্তাদের নতুন আয়ের উৎস হিসেবে কাজ করছে। বন্দিদের কোয়ারেন্টিনে থাকার জন্য কত টাকায় কী ধরনের সুযোগ দেওয়া হবে, তা-ও নির্ধারণ করা হয় আমদানি সেলে।

কোয়ারেন্টিনে টাকার বিনিময়ে পছন্দের বন্দি নিয়ে মাত্র কয়েক দিন থাকারও ব্যবস্থা করা হয়। চিকিৎসা সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রেও একই নিয়ম। মুক্তি পাওয়া বন্দিরা জানান, কারাগারের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, কারারক্ষী এবং প্রভাবশালী কিছু বন্দির লুটপাটের অন্যতম উৎস। টেলিফোন থেকে প্রতিদিন ৫০ থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় হয়।

সিমভিত্তিক ২০টার মতো ল্যান্ডফোন চালু রয়েছে এ দুটি কারাগারে। এই ফোন কে কতক্ষণ ব্যবহার করবে তাও টাকার বিনিময়ে নির্ধারণ হয়ে থাকে বলে জানাগেছে। বেশি টাকায় ফোন ব্যবহারের বিষয়ে পর্যবেক্ষণ মুক্ত থাকারও সুযোগ মেলে। কারাগারের ক্যান্টিনও অবৈধ আয়ের আরেকটি উৎস। টাকা ছড়ালে এ ক্যান্টিনে সব কিছুই পাওয়া যায়। তবে বাইরের চেয়ে ২০ গুণ বেশি দামে তা কিনতে হয়। ক্যান্টিনে গরুর মাংসের কেজি প্রায় ১২০০ টাকা। জামালপুর ও শেরপুর কারাগারে বন্দিদের জন্য সরকারের বরাদ্দ খাবার নিয়ে চলছে হরিলুট ।

তবে সদ্য মুক্তি পাওয়া রাজিব নামের এক হাজতি জানান, ডিআইজি প্রিজন স্যারের তদারকির কারনে ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগারে নিম্নমানের খাবার বিতরন করতে পারছেন না কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বর্তমানে খাবার পেয়ে খুশি বন্দিরাও। জানাগেছে, কারাগারে আরেক ভীতির নাম চিফ রাইটার। চিফ রাইটারদের মাধ্যমেই লুটপাট ও লুটপাটের টাকার ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে থাকে। যে কেউ এই চিফ রাইটার হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে না। বড় ধরনের অপরাধী হওয়াও চিফ রাইটারদের অন্যতম যোগ্যতা। চিফ রাইটারদের রুম ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে। একজন সাংবাদিক জানান, জামালপুর ও শেরপুর কারাগারের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা তাদের অবৈধ কারবার অব্যাহত রাখতে জেলা কারাগারে কোনো সাংবাদিক রাখতে চান না, করেন খারাপ ব্যবহার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!